প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প না হলে এগুবে না কৃষি

মু. আরেফিন

প্রকাশ: ০৮:২৩, ১ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ১৪:১৮, ১ জুলাই ২০২৫

প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প না হলে এগুবে না কৃষি

বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ফল, সবজি, মাছ, দুধ ইত্যাদি উৎপাদিত হয়। তবে সংরক্ষণ প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা না থাকায় এর একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। যেমন, অনেক সময় আম, কাঁঠাল বা টমেটো অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে বাজারে সস্তায় বিক্রি হয় বা পচে যায়। ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি থাকলে এসব কাঁচামাল থেকে জুস, পিউরি, চিপস বা শুকনো খাদ্য তৈরি করে অপচয় রোধ করা সম্ভব।

কিন্তু দেশে ফুড প্রসেসিং খাতে পিছিয়ে থাকার অনেক কারণ রয়েছে, যা দেশের কৃষি শিল্প উভয় খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যদিও বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, কৃষিপণ্যের সিংহভাগই প্রক্রিয়াজাত না হয়ে কাঁচা অবস্থায় বাজারজাত হয়। এতে যেমন কৃষিপণ্যের অপচয় বাড়ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।

প্রথমত, দেশে আধুনিক প্রযুক্তির ঘাটতি রয়েছে। অধিকাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে উৎপাদন হয়, যার ফলে উৎপাদনের গতি মান দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন, রংপুর অঞ্চলে আলু প্রচুর উৎপাদিত হলেও তা থেকে চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বা আলুর গুঁড়া তৈরির কারখানা খুবই সীমিত। এতে কৃষকরা মৌসুম শেষে ন্যায্য দাম পান না এবং অনেক আলু সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, দক্ষ জনবলের অভাব একটি বড় কারণ। ফুড টেকনোলজি বা ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সীমিত, ফলে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে লোকবল সংকট থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাহাড়ি অঞ্চলে কলা, কাঁঠাল প্রচুর উৎপন্ন হলেও এগুলো থেকে নানা ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবার তৈরির উদ্যোগ কম। তবে রাঙামাটিতে তিন উদ্যোক্তার উদ্যোগে কাঁঠাল কলার চিপস তৈরির উদ্যোগ একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ, যা দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও অনুকরণীয় হতে পারে।

তৃতীয়ত, সংরক্ষণ পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতাও পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ। দেশে পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ বা হিমাগার না থাকায় পচনশীল খাদ্যসামগ্রী দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করা যায় না। দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর আম, লিচু কাঁঠাল উৎপাদিত হলেও প্রক্রিয়াজাত করার সুযোগ না থাকায় তা মৌসুম শেষে নষ্ট হয়ে যায়।

চতুর্থত, বাজার সংযোগ ব্র্যান্ডিংয়ে দুর্বলতা আছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আন্তর্জাতিক মানে তুলনামূলকভাবে কম পৌঁছাতে পারে। পণ্যের মান, স্বাদ, প্যাকেটিং হাইজিন নিশ্চিত করতে না পারায় অনেক প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ে। যেমন, বাংলাদেশে উৎপাদিত শুকনো পেঁয়াজ বা আদা থেকে গুঁড়া তৈরির সম্ভাবনা থাকলেও মান বজায় না থাকায় রপ্তানি কম।

পঞ্চমত, সরকারি নীতিগত সহায়তা পর্যাপ্ত নয়। এই খাতে উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ ট্যাক্স ছাড় তেমন নেই। ফলে অনেকেই এই খাতে বিনিয়োগ করতে ভয় পান। আবার অনেক ক্ষেত্রেই ছোট উদ্যোক্তারা সরকারি সহায়তা পাওয়ার প্রক্রিয়ায় জটিলতা দুর্নীতির মুখোমুখি হন।

ফুড প্রসেসিং খাতে গবেষণা উদ্ভাবনের অভাবও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন খাদ্যপণ্য উদ্ভাবন সংরক্ষণের প্রযুক্তি দেশে খুবই সীমিত পরিসরে রয়েছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা হলেও তা বাজারে প্রয়োগ বা প্রযুক্তি স্থানান্তর তেমন হচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য তৈরির গবেষণা হলেও তা শিল্প পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

ফলস্বরূপ, ফুড প্রসেসিং খাত দেশের কৃষি উৎপাদনের পুরো সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছে না। অথচ এই খাত উন্নত হলে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হবে, কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে এবং রপ্তানি আয় বহুগুণে বাড়বে। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত এই খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, গবেষণা উদ্যোক্তা সহায়তায় বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা।

আরও পড়ুন