কৃষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব ও কৃষি বিপ্লব

প্রকাশ: ১৩:৩৯, ৩০ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৪:৪২, ১ জুলাই ২০২৫

কৃষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব ও কৃষি বিপ্লব

বাংলাদেশের কৃষি খাত এখন আর শুধু জমি, হাল, গরু আর মৌসুমী বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল নয়। তথ্য প্রযুক্তির বিস্ময়কর বিকাশ বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমযেমন ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক ইনস্টাগ্রামগ্রামীণ কৃষকদের জীবনে এনেছে এক নতুন সম্ভাবনার আলো। একে বলা যায় "ডিজিটাল কৃষির" প্রাথমিক স্তর, যেখানে একটি স্মার্টফোনই হয়ে উঠেছে কৃষকের পরামর্শক, প্রশিক্ষক এবং বাজারদর্শন।

একসময় কৃষকরা নির্ভর করতেন স্থানীয় কৃষি অফিসার বা দোকানদারের পরামর্শের উপর। এখন সময় বদলেছে। একজন কৃষক আজ ইউটিউব ভিডিও দেখে বুঝতে পারছেন কীভাবে কম খরচে জৈব সার তৈরি করা যায়, কীভাবে টমেটো চাষে সাসপেনশন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয় কিংবা কীভাবে পুকুরে তেলাপিয়া মাছ চাষ করা যায়।

নওগাঁর মান্দার কৃষক জাহাঙ্গীর আলম ফেসবুকের একটি কৃষি-গ্রুপ থেকে শিখে শুরু করেন বিষমুক্ত সবজি চাষ। এখন তিনি তার জৈব সবজি ঢাকায় অনলাইনে বিক্রি করছেন। ইউটিউবে নিজের চাষ পদ্ধতির ভিডিও আপলোড করে তিনি অন্য কৃষকদের কাছ থেকেও প্রশংসা পাচ্ছেন। একইভাবে কুড়িগ্রামের সাবিনা ইয়াসমিন টিকটকে নিয়মিত কৃষি বিষয়ক টিপস শেয়ার করে এখন নিজস্ব একটি ভিন্ন পরিচিতি গড়ে তুলেছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কৃষকদের শুধু চাষের পদ্ধতিই শেখাচ্ছে না, বরং বাজার ব্যবস্থাপনায় সরাসরি যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। আগে যেখানে মধ্যস্বত্বভোগীর উপর নির্ভর করে পণ্য বিক্রি করতে হতো, এখন একজন কৃষক ফেসবুকে পেইজ খুলে সরাসরি তার উৎপাদিত ধান, শাক-সবজি, দুধ কিংবা হাঁস-মুরগি বিক্রি করতে পারছেন। এর ফলে কৃষক পাচ্ছেন ন্যায্য মূল্য, আর ভোক্তাও পাচ্ছেন টাটকা পণ্য।

রাজবাড়ীরকৃষক বন্ধু কৃষি বাজারনামক একটি ফেসবুক পেইজ এখন প্রায় ,০০০ কৃষকের সাথে যুক্ত। এখান থেকে শহরের ভোক্তারা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনে থাকেন। এমন প্ল্যাটফর্মগুলো ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য এক বিকল্প বাজার তৈরি করছে।

সামাজিক মাধ্যমে কৃষিবিদ, বিশেষজ্ঞ উদ্যোক্তারা নিয়মিত ভিডিও, লাইভ সেশন পোস্টের মাধ্যমে তথ্য দিচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক “Agri Doctor” নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে নিয়মিত চাষাবাদ, কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ে ভিডিও আপলোড করেন। এতে করে সহজেই কৃষকরা ঘরে বসেই প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন।

তবে এর সঙ্গে কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। ভুল তথ্য বা অপারিপক্ব টিপস অনুসরণ করে কিছু কৃষক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন। অনেক সময় ভুল রোগ নির্ণয় কিংবা অনুপযুক্ত কীটনাশকের পরামর্শ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ছে, যা ফসলের ক্ষতি করছে।

২০২৩ সালে বগুড়ায় কিছু কৃষক টিকটকের একটি ভিডিও দেখে একটি নতুন কীটনাশক প্রয়োগ করে পুরো ধানের ক্ষেত নষ্ট করেন। পরে কৃষি অফিসার এসে জানান, সেই তথ্যটি ছিল পুরোপুরি ভুল বিভ্রান্তিকর।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের জন্য ডিজিটাল কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, ভেরিফায়েড কৃষি তথ্যভিত্তিক অ্যাপ, এবং সরকারি পর্যায়ে কৃষি ইনফ্লুয়েন্সার গড়ে তোলাএসব উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (DAE) ইতিমধ্যে কিছু ডিজিটাল উদ্যোগ নিয়েছে যেমন "কৃষক বন্ধু অ্যাপ", কিন্তু তার আরও ব্যাপক প্রসার দরকার। সরকারি ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেইজ, লাইভ প্রশিক্ষণ FAQ ভিত্তিক ভিডিও প্রচার এই খাতে বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার কৃষিকে শুধু তথ্যপ্রযুক্তির সাথে যুক্ত করছে না, এটি এক ধরনের 'ডিজিটাল কৃষি সংস্কৃতি' তৈরি করছে। এখান থেকে কৃষকের ক্ষমতায়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি, বাজার সংযোগ এবং কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও নতুন পথ তৈরি হচ্ছে। তবে এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সময় এসেছে কৃষিকে ডিজিটাল যুগে সমৃদ্ধ সুরক্ষিত করার, আর সেই যাত্রার অন্যতম সহযাত্রী হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

আরও পড়ুন