রাজশাহী, যেন এক স্বপ্নপুরী!!!
কৃষিবিদ মুহম্মদ আশরাফুল ইসলাম
প্রকাশিত: ১৫:৪৮, ১৭ আগস্ট ২০২০

ক’দিন আগের কথা, গত ঈদুল আযহা’র ছুটিতে আমরা স্বপরিবারে রাজশাহীতে। করোনা জনিত কারণে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাব না, এমনটাই সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু প্রথম দিনই ছুটতে হলো বাবা মায়ের ওষুধ কিনতে লম্বা ফর্দ নিয়ে লক্ষীপুর মোড়ে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রেলগেট পেরিয়ে গ্রেটার রোড ধরতেই চোখ আটকে গেল সড়ক বিভাজন করা আইল্যান্ডে। কী অপরূপ সাজে সেজেছে আইল্যান্ডগুলো। নানা রঙের বাহারী ফুল ও বৃক্ষে শোভিত হয়ে আছে সড়ক বিভাজন।
আমি চোখ ফিরাতে পারছি না। যতই এগিয়ে চলেছি, ততই মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে পথের মাঝের ফুলেল বৃক্ষরাজি। বর্ষায় এমন ফুলের মেলা আর কী এদেশের কোন শহরের সড়ক বিভাজনে আছে? সড়ক বিভাজনের চারপাশ নকশা করা কংক্রিটের বার দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছে। সাধারণ ভাবে মনে হয়, একটি গাছের গুড়ির সাথে আর একটি গাছের গুড়ি জোড়া দিয়ে জিকজ্যাক আকারে এই বেড়া বানানো হয়েছে। বেড়াটিও নিপুণ শিল্পীর হাতে তৈরী। ভিতরে লাগানো হেজ প্লান্ট। মালির সযত্নে লালন ও ছাঁটাই করা হেজ গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ধরণের ফুল ও শোভা বর্ধনকারী গাছ লাগানো হয়েছে।
নানা প্রজাতির ফুলের মধ্যে মন কেড়ে নিল সাদা, বেগুনী ও লাল রঙের ফুরুস ফুল (যাকে অনেকেই চেরীফুল বলে থাকে), জারুল ফুল, রঙ্গন, কাঠ গোলাপ, অলকানন্দ, করবী, কলকে ফুল ইত্যাদি। আইল্যান্ডের পাদদেশটিও বিভিন্ন রঙ্গে রঞ্জিত। বাতাসে ফুল, ডগা, পাতাগুলো দোল খাচ্ছে। লোভ সামলাতে পারলাম না। রিক্সা থেকে নেমে আইল্যান্ডের ধারে চলে গেলাম। কাছে যেতেই ভেসে এল মোহনীয় সুবাস। ফুলের মধ্য দিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পথিকদের যেন পাতা নেড়ে অভ্যার্থনা জানাচ্ছে পাম গাছগুলো। সব মিলিয়ে এক স্বর্গীয় মনোরম শোভা।
সুরক্ষার জন্য পরিকল্পিতভাবে সড়ক বিভাজনের ভিতর কোন বড় বৃক্ষ লাগানো হয়নি। আইল্যান্ডের বিপরীতে রাস্তার ধারেও দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ফুলেল বৃক্ষ; কনকচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কাঞ্চন ফুল ইত্যাদি। ফাঁকে ফাঁকে ছাতিম গাছ লাগিয়ে ছোট গাছকে রক্ষা করার জন্য ঘিরে দেয়া হয়েছে। গাছগুলো একটু বড় হয়ে ঘেরা পেরিয়ে মাথা উঁচু করে গাঢ় সবুজের আহ্বান জানাচ্ছে। এদের দিকে না তাকিয়ে কি পারা যায়? ছাতিম গাছের মূলাবর্তে আম পাতার আকৃতির ৭টি পাতা থাকে, তাই তাকে সপ্তপর্ণা/পর্ণী বলে।
আগে দাদী-নানীরা ছাতিম গাছে ভূতের গল্প শুনাতো। গল্প শুনতে শুনতে গা ছম ছম করে উঠত তখন। ছাতিম গাছের কাছে এসে তাঁদের কথা মনে পড়ে গেল। রাস্তার ধারের বাড়ীগুলোতেও জুঁই, কেয়া, দোপাটি (গোলাপি, লাল, বেগুনি, আকাশি, নীল ও সাদা রঙের), টগর, মালতিলতা, দোলনচাপা ইত্যাদি নানান ফুলের দেখা মিলল। বর্ষায় বিশেষ করে মালতি লতার লাল সাদা মিশ্রনের ফুলরাশি আমাকে আনমনা করে দিল। গুনগুন করে গাইলাম ‘ওই মালতি লতা দোলে....’। বস্তুত এ রাস্তাটির আমি যেন প্রেমে পড়ে গেলাম। তাই রাজশাহীতে এক সপ্তাহ অবস্থানকালের মধ্যে ৪দিনই আমি সুযোগমত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে রাস্তার ধার ধরে রিক্সায় অথবা হেঁটে ঘুরে আসতাম । এছাড়া একদিন পরিবার নিয়ে পদ্মার পাড় ঘুরে আসতেও ভুল করিনি।
আমরা জানি, ২০১৬ সালে রাজশাহী নগরী পরিবেশ দূষণ রোধে বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এ ছাড়া ২০০৬, ২০০৯ ও ২০১২ সালে দেশের মধ্যে বৃক্ষরোপণে রাজশাহী নগরী প্রথম হয়েছিল। তাই রাজশাহীকে শিক্ষা নগরীর পাশাপাশি বনজ নগরীও বলা যেতে পারে। রাজশাহীর মত পরিপাটি শহর এদেশে আর একটিও নেই, আমার বিশ্বাস।
চাকুরীর সুবাদে বাংলাদেশের প্রায় সব জেলা শহরই আমার দেখা হয়েছে। আমার চোখে রাজশাহী দেশের সবচেয়ে সুন্দর শহর। শুধু আমি নই, আমার সাথে বিভিন্ন সময় বহু বিদেশী নাগরিক রাজশাহী পরিভ্রমণে এসেছিলেন। তাঁরা আমার সাথে সমস্ত শহর ঘুরে এক বাক্যে বলেছেন-রাজশাহীই সেরা। আমিও গর্বিত, সেরা শহরেই মানুষ হয়েছি বলে। সুন্দর থেকেই সুন্দর হতে শেখা। এখানেই আমার মা-বাবা’র বাস। আছে অসংখ্য আত্মীয়, বন্ধু, পরিজন। তাই যখনি ছেড়ে যাই রাজশাহী, মনের মাঝে বিচ্ছেদের সুর বাজে।
লেখক: কনসালট্যান্ট, কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্প (৩য় পর্যায়), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামাড়বাড়ি, ঢাকা।
